‘আই লাভ মুহাম্মদ’ স্লোগানে মামলা ও গ্রেপ্তার, ভারতের উত্তর প্রদেশে মুসলিমদের দমন পীড়ন
ভারতের উত্তর প্রদেশসহ কয়েকটি বিজেপি শাসিত রাজ্যে শত শত মুসলমানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। তাদের অভিযোগ—‘আই লাভ মুহাম্মদ’ (আমি মুহাম্মদকে ভালোবাসি) লেখা ব্যানার ও স্লোগান তুলে ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট করা হয়েছে।
ঘটনাটি শুরু হয় ৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় উত্তর প্রদেশের শিল্পনগরী কানপুরে। সেদিন স্থানীয় মুসলমানেরা নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মদিন উপলক্ষে সাইয়েদ নগর এলাকায় আলোকসজ্জা করেন। সেখানে একটি সাইনবোর্ডে লেখা ছিল—“I ❤️ Muhammad”।
এমন আয়োজন ওই এলাকায় প্রথমবারের মতো দেখা যায়। তবে সাইনবোর্ড জ্বলে উঠতেই একদল হিন্দু পুরুষ আপত্তি জানায়। পরে পুলিশ এসে দীর্ঘ সময়ের উত্তেজনার পর ব্যানারটি সরিয়ে নেয়।
এরপর নয়জন মুসলমান ও অজ্ঞাত ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। অভিযোগ—তারা ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছেন ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের চেষ্টা করেছেন। যদিও এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
হিন্দু সংগঠন শ্রী রামনবমী সমিতির সদস্য মোহিত বাজপেয়ি বলেন, “আমার সাইনবোর্ডের লেখায় আপত্তি নেই। কিন্তু এটি এমন জায়গায় লাগানো হয়েছিল, যেখানে আমরা রামনবমী উৎসবের সাজসজ্জা করি।”
অন্যদিকে মুসলিম বাসিন্দারা বলেন, ওই স্থানটি প্রতি বছরই নবী দিবসের অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহার করা হয় এবং সাইনবোর্ডের জন্য সরকারি অনুমতিও ছিল।
কানপুরের ঘটনার পর ১০ সেপ্টেম্বর উত্তর প্রদেশের আরেক শহর বারেলিতেও নয়জন মুসলমানের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। অভিযোগ—তারা নতুন এক ‘ধর্মীয় প্রথা’ শুরু করে জনশৃঙ্খলা নষ্ট করেছেন।
২১ সেপ্টেম্বর মুসলিম সংগঠন ইত্তেহাদে মিল্লাত কাউন্সিলের (আইএমসি) নেতা মাওলানা তৌকির রাজা খান এসব মামলার প্রতিবাদে সমাবেশের ডাক দেন। প্রশাসন অনুমতি না দিলেও ২৬ সেপ্টেম্বর শুক্রবার নামাজের পর হাজারো মানুষ সমাবেশ করে “I love Muhammad” লেখা পোস্টার নিয়ে বিক্ষোভে অংশ নেন।
পুলিশ অভিযোগ করে, ওই বিক্ষোভ অনুমতি ছাড়া অনুষ্ঠিত হয় এবং অংশগ্রহণকারীরা পাথর নিক্ষেপ ও ভাঙচুর করেছেন। পরে পুলিশ লাঠিচার্জ করে, খানসহ বহু মানুষকে গ্রেপ্তার করে এবং শহরের ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়।
গ্রেপ্তারের আগে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় মাওলানা খান বলেন, “ধর্মীয় অনুভূতি দমন করলে তার প্রতিক্রিয়া ভয়াবহ হবে।”
পরদিন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলেন, “বারেলির ঘটনা ছিল সামাজিক সম্প্রীতি নষ্টের সুপরিকল্পিত চেষ্টা।” তিনি ইঙ্গিত করে বলেন, “কখনও কখনও মানুষ নিজের পুরোনো অভ্যাস ছাড়তে পারে না, তাই একটু ‘ডেন্টিং-পেন্টিং’ দরকার।”
এরপরই বারেলিতে অভিযুক্ত এক ব্যক্তির মালিকানাধীন কমিউনিটি সেন্টার বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয় প্রশাসন।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এ ধরনের ভাঙচুর বিচারবহির্ভূত শাস্তি এবং সংবিধানবিরোধী। সরকারের দাবি, ভবনগুলো অবৈধ নির্মাণ হলেও সময় ও লক্ষ্যবস্তু বেছে নেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে।
সুমাইয়া রানা, প্রখ্যাত উর্দু কবি মুনাওয়ার রানার কন্যা, বলেন, “পুলিশ সারা দেশে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছে। সরকারের উদ্দেশ্য ভয় সৃষ্টি করা, যাতে মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় ও মৌলিক অধিকারের কথা বলতে না পারে।”
মানবাধিকার সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অব সিভিল রাইটস (APCR) জানিয়েছে, দেশজুড়ে অন্তত ২২টি মামলা হয়েছে, নাম রয়েছে ২,৫০০ জনের বেশি মানুষের, আর বারেলিতেই গ্রেপ্তার ৮৯ জন।
সংগঠনটির সম্পাদক নাদিম খান বলেন, “নবীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশকে অপরাধ হিসেবে দেখানো হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া মানা হয়নি এবং অভিযুক্তদের সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়েছে, যা মুসলিম সমাজের ওপর গভীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলছে।”
অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডের সদস্য এসকিউআর ইলিয়াসি বলেন, “শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কোনো অপরাধ নয়। নবীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ আমাদের সাংবিধানিক অধিকার।”
মানবাধিকারকর্মী বন্দনা মিশ্র বলেন, “হিন্দু সম্প্রদায়কে ধর্মীয় স্লোগান দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়, কিন্তু মুসলমানদের ক্ষেত্রে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। এটি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক নীতির পরিপন্থী।”
উত্তর প্রদেশের প্রধান বিরোধী দল সমাজবাদী পার্টি সরকারের পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছে। দলটির নেতা মতপ্রসাদ পান্ডে বলেন, “সরকার গণতন্ত্রের কথা বলে, কিন্তু বাস্তবে তা অমান্য করছে। আমরা বারেলিতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের দেখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমাদের বাধা দেওয়া হয়েছে।”
অভিযুক্তদের পক্ষে কাজ করা আইনজীবী জিয়া জিল্লানি বলেন, “যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তারা সবাই দিনমজুর শ্রেণির মানুষ। তাদের আর্থিক অবস্থার কারণে ন্যায়বিচারের লড়াই চালানো তাদের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “এই ঘৃণার রাজনীতি গরিবদের টার্গেট করছে, তাদের অসহায়ত্বকে ব্যবহার করে ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে সরকার।”
মন্তব্য করুন