logo
  • মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ৩০ আশ্বিন ১৪৩২

ভারতে ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ বলায় কেন মুসলমানদের বিচার করা হচ্ছে?

অনুবাদিত প্রতিবেদন

  ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ১৩:৫৯
আল জাজিরা

লেখক: ইয়াসরাজ শর্মা

গত এক মাস ধরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন হিন্দুত্ববাদী দলের প্রশাসনে মুসলিম পুরুষদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তাদের বাড়িঘরও ভাঙা হয়েছে।
অভিযোগের মূল বিষয় এক—পোস্টার, টি-শার্ট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে “আই লাভ মুহাম্মদ” লেখা। এটি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ। কর্তৃপক্ষ বলছে, এই বাক্যটি “জনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত” করছে।

বিরোধ ও গ্রেপ্তার অভিযান
এ পর্যন্ত অন্তত ২,৫০০ ভারতীয় মুসলিম নাগরিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং ৪০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই তথ্য দিয়েছে বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অব সিভিল রাইটস (এপিসিআর)।

৪ সেপ্টেম্বর উত্তর প্রদেশের কানপুরে ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে এক এলাকায় “আই লাভ মুহাম্মদ” লেখা আলোকিত বোর্ড টানানো হয়। কিছু স্থানীয় হিন্দু অভিযোগ করেন, এটি ঐতিহ্যবাহী উৎসবে নতুন সংযোজন, যা উত্তর প্রদেশের আইন অনুযায়ী অনুমোদিত নয়। এরপর পুলিশ ধর্মীয় বিভেদ উসকে দেওয়ার অভিযোগে ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে। এই অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।

ঘটনাটি ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয় এবং প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে তেলেঙ্গানা, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, উত্তরাখণ্ড ও জম্মু-কাশ্মীরসহ বিভিন্ন রাজ্যে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, পোশাকে ও পোস্টারে “আই লাভ মুহাম্মদ” স্লোগান ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।

২৬ সেপ্টেম্বর উত্তর প্রদেশের বেয়ারেলিতে এক ইমামের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। পরে পুলিশ ৭৫ জনকে গ্রেপ্তার করে, যার মধ্যে ইমাম তাওকির রাজা ও তার আত্মীয়রা ছিলেন। স্থানীয় প্রশাসন তাদের কয়েকটি ভবনও বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে বহু মুসলমান এমন বুলডোজার অভিযানে ঘরবাড়ি হারিয়েছেন, যেগুলো অনেক সময় কোনো আদালতের আদেশ ছাড়াই পরিচালিত হয়েছিল। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, বাড়িঘর ভাঙা কোনো শাস্তি হতে পারে না এবং আগে থেকে নোটিশ দেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবে তা প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়।

এ ছাড়া গুজরাটসহ একাধিক রাজ্যে “আই লাভ মুহাম্মদ” লেখা পোস্ট বা ভিডিও প্রকাশের কারণে আরও বহু মুসলমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এ কি বেআইনি?
ভারতের সংবিধান ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করে। সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদে ধর্ম পালনের স্বাধীনতা এবং ১৯(১)(ক) অনুচ্ছেদে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে—যতক্ষণ না তা সহিংসতা বা ঘৃণা উসকে দেয়।

কিন্তু এই মামলাগুলোর ক্ষেত্রে পুলিশ সাধারণত এমন ধারায় অভিযোগ করছে, যেখানে বড় জনসমাবেশ বা ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টির অভিযোগ আনা যায়। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেওয়া বা “আই লাভ মুহাম্মদ” লেখা পোশাক পরার ক্ষেত্রেও এসব আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে।

এপিসিআরের জাতীয় সমন্বয়ক নাদিম খান বলেন, কর্তৃপক্ষ খুব সচেতনভাবে এমন আইন প্রয়োগ করছে যা সরাসরি “আই লাভ মুহাম্মদ” বাক্যকে অপরাধ বলে না, বরং সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডকে অপরাধ হিসেবে দেখায়। “তারা জানে, এই বাক্য বলা বা লেখা নিজেই কোনো অপরাধ নয়,” বলেন খান। তিনি আরও বলেন, ভারতে হিন্দু দেবদেবীর অস্ত্রধারী ছবি সর্বত্র দেখা যায়, যা কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করতে পারে, কিন্তু তাতেও তো মামলা হয় না। “সরকার কোনো ধর্মকে অপরাধ হিসেবে দেখাতে পারে না,” তিনি যোগ করেন।

অধিকার ও উদ্বেগ
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান আকার প্যাটেল বলেন, “‘আই লাভ মুহাম্মদ’-এর মতো শান্তিপূর্ণ স্লোগান কোনোভাবেই অপরাধ নয়। এটি ভারতের সংবিধান বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের কোনো ধারা ভঙ্গ করে না।” তিনি আরও বলেন, “জনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে ধর্মীয় পরিচয় বা প্রকাশের স্বাধীনতা দমন করা যায় না। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো সবার অধিকার সমানভাবে রক্ষা করা, তা সীমিত করা নয়।”

বৈষম্যের ধারাবাহিকতা
সমালোচকদের মতে, এ অভিযান নতুন কিছু নয়। মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে মুসলমানদের প্রতি বৈষম্য, সহিংসতা ও আইনি হয়রানি বেড়েছে। গত ১১ বছরে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণাবাচক বক্তব্যের ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ২০২৩ সালে ৬৬৮টি থেকে ২০২৪ সালে তা বেড়ে ১,১৬৫-এ পৌঁছেছে—প্রায় ৭৪ শতাংশ বৃদ্ধি। এর বেশিরভাগই বিজেপি-শাসিত রাজ্য বা নির্বাচন-পূর্ব এলাকায় ঘটেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক আসিম আলি বলেন, “এখন স্থানীয় সংঘাতগুলো মুহূর্তেই জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়। একটি সংগঠিত প্রচারণা চলছে, যেখানে মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঘৃণা ছড়িয়ে দিচ্ছে। মুসলমানদের ধর্মীয় পরিচয়ের যেকোনো প্রকাশকেই উসকানি হিসেবে দেখানো হচ্ছে।”

কানপুর ঘটনার পর মোদির নির্বাচনী এলাকা বারাণসীতে বিজেপি নেতারা “আই লাভ বুলডোজার” লেখা পোস্টার টানান, যা বাড়িঘর ধ্বংস অভিযানের প্রতি সমর্থন হিসেবে দেখা হয়।

তরুণ মুসলমানদের প্রভাবিত করছে কিভাবে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক রশিদ কিদওয়াই বলেন, “‘আই লাভ মুহাম্মদ’ বিতর্ক মূলত রাজনৈতিক, ধর্মীয় নয়।” তিনি বলেন, মুসলিম তরুণদের মধ্যে এখন হতাশা বাড়ছে। তারা মনে করছে, একই দেশের নাগরিক হয়েও সবার জন্য সমান নিয়ম প্রযোজ্য নয়।

এপিসিআরের তথ্যমতে, গ্রেপ্তার হওয়া অনেকেই তরুণ। বিশ্লেষক আসিম আলি বলেন, “এমন দমননীতি তরুণ মুসলমানদের আরও বিচ্ছিন্ন করছে। এখন এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে কেবল মুসলমান হওয়াই অপরাধের মতো।” তিনি যোগ করেন, “প্রতিদিন ঘৃণার মাত্রা আরও বাড়ছে। ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তা কল্পনাও করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।”

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
12