‘নো কিংস’ আন্দোলন জনসমুদ্রে পরিণত: ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্তৃক গৃহিত নীতিসমূহের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডিসি, শিকাগো, মায়ামি এবং লস অ্যাঞ্জেলেসসহ বিভিন্ন শহরে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে আসে।
নিউইয়র্ক সিটির বিখ্যাত টাইমস স্কয়ারে সকাল থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়। সড়ক ও সাবওয়ে প্রবেশপথ ভরে যায় প্রতিবাদকারীদের ভিড়ে। অনেকেই হাতে প্ল্যাকার্ড ধরে রেখেছিলেন, তাতে লেখা ছিল—“গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র নয়” এবং “সংবিধান ঐচ্ছিক নয়”।
বিক্ষোভের আগেই ট্রাম্পের মিত্ররা অভিযোগ করেন, এই আন্দোলনের সঙ্গে “অ্যান্টিফা” নামের বামপন্থী গোষ্ঠীর যোগ আছে। তারা একে “আমেরিকা-বিরোধী সমাবেশ” বলে আখ্যা দেয়। তবে আয়োজকরা জানান, সব আয়োজন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
‘নো কিংস’ এর আয়োজকরা তাদের ওয়েবসাইট জানায় যে— “অসহিংসতা আমাদের মূলনীতি।” আয়োজকরা অংশগ্রহণকারীদের যেকোনো সংঘাত এড়িয়ে চলার আহ্বান জানিয়েছে।
নিউইয়র্কে গণজোয়ার
টাইমস স্কয়ার ও আশপাশের এলাকায় প্রতিবাদকারীরা বারবার স্লোগান দেন—“এটাই গণতন্ত্রের রূপ।” ঢোল, কাউবেল ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজে পুরো এলাকা মুখর হয়ে ওঠে।
আকাশে হেলিকপ্টার ও ড্রোন ওড়ার পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্ট জানায়, শহরের পাঁচটি অঞ্চলে মোট এক লাখেরও বেশি মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভে অংশ নেয় এবং কাউকে গ্রেপ্তার করা হয় নি।
একজন পুলিশ কর্মকর্তা অনুমান করেন, শুধু সপ্তম এভিনিউতেই ২০ হাজারের বেশি মানুষ মিছিল করেছিলো।
ফ্রিল্যান্স লেখক বেথ জাসলোফ বলেন, তিনি এই বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন কারণ ট্রাম্প প্রশাসনের “স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা” দেখে তিনি আতঙ্কিত। “আমি নিউইয়র্ক শহরকে ভালোবাসি,” তিনি বলেন। “এত মানুষের সঙ্গে একসঙ্গে দাঁড়ানো আমাকে আশার আলো দেখায়।”
ট্রাম্প প্রশাসনের পদক্ষেপ ও সমালোচনা
জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার পর থেকে ট্রাম্প নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভেঙে দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং গভর্নরদের আপত্তি সত্ত্বেও সেনা মোতায়েন করেছেন। এছাড়া তিনি প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের আইনপ্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের তার “রাজনৈতিক শত্রুদের” বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানিয়ে রেখেছেন।
ট্রাম্প বলেন, “দেশ পুনর্গঠনের জন্য এসব পদক্ষেপ প্রয়োজন,” এবং তাকে “স্বৈরশাসক” বা “ফ্যাসিস্ট” বলা “অতিরঞ্জিত প্রতিক্রিয়া।” তবে সমালোচকরা সতর্ক করেছেন, এসব পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের জন্য হুমকির কারণ হকত পারে।
নিউ জার্সির বাসিন্দা ও অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী মাসিমো মাসকোলি বলেন, “আমি ইতালির এক প্রতিরোধ যোদ্ধার নাতি। আমার চাচা মুসোলিনির সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগ দেন এবং ফ্যাসিস্টদের হাতে নিহত হন। আমি কখনও ভাবিনি ৮০ বছর পর আমেরিকায় আবার ফ্যাসিবাদের ছায়া দেখব।”
তিনি ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন নীতি ও স্বাস্থ্যসেবা কমানোর পদক্ষেপ নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। “আমরা এখন কোনো প্রতিষ্ঠানেই আস্থা রাখতে পারি না—না সুপ্রিম কোর্টে, না কংগ্রেসে, না সরকারের ওপর,” তিনি বলেন। “তাই আমরা লড়ছি।”
রাজনীতিকদের অংশগ্রহণ
নিউইয়র্কের ডেমোক্র্যাট সিনেট সংখ্যালঘু নেতা চাক শুমারও বিক্ষোভে যোগ দেন। তিনি এক্স (পূর্বে টুইটার)-এ লিখেন, “আমেরিকায় কোনো রাজা নেই, এবং আমরা ট্রাম্পকে আমাদের গণতন্ত্র ধ্বংস করতে দেব না।”
ওয়াশিংটন ডিসিতে সেনেটর বার্নি স্যান্ডার্স প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত হয়ে বলেন, “আমরা আমেরিকাকে ঘৃণা করি না, আমরা এখানে এসেছি কারণ আমরা আমেরিকাকে ভালোবাসি।”
যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও প্রতিধ্বনি
ইউরোপের বার্লিন, মাদ্রিদ ও রোমেও সংহতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। লন্ডনে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সামনে কয়েক শত মানুষ বিক্ষোভ করে।
কানাডার টরন্টোতেও একইভাবে মার্কিন কনস্যুলেটের সামনে বিক্ষোভ হয়, যেখানে ব্যানারে লেখা ছিল—“কানাডাকে হাত দিও না।”
রিপাবলিকানদের প্রতিক্রিয়া ও নিরাপত্তা প্রস্তুতি
ফক্স নিউজে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেন, “তারা আমাকে রাজা বলছে, কিন্তু আমি রাজা নই।” কানসাসের রিপাবলিকান সিনেটর রজার মার্শাল বলেন, “আশা করি এটি শান্তিপূর্ণ হবে, যদিও আমি সন্দেহ আছে।”
বিক্ষোভের আগে টেক্সাস, ভার্জিনিয়া ও আরও কয়েকটি রাজ্যে রিপাবলিকান গভর্নররা ন্যাশনাল গার্ডকে প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দেন। টেক্সাসের গভর্নর গ্রেগ অ্যাবট বলেন, “অ্যান্টিফা-সম্পর্কিত” পরিকল্পিত সমাবেশের কারণে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে রাজ্যের ডেমোক্র্যাট নেতা জিন উ বলেন, “শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ দমনে সশস্ত্র সেনা পাঠানোই রাজতন্ত্রের আচরণ, গণতন্ত্রের নয়।”
ওয়াশিংটন ডিসিতে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন থাকলেও শনিবারের বিক্ষোভে তাদের দেখা যায়নি।
জনমত ও রাজনৈতিক বিভাজন
সাম্প্রতিক রয়টার্স/ইপসোস জরিপে দেখা গেছে, ট্রাম্পের কার্যক্রমে সমর্থন জানিয়েছেন মাত্র ৪০ শতাংশ আমেরিকান, আর ৫৮ শতাংশ অসন্তুষ্ট। এটি তার প্রথম মেয়াদের গড় জনপ্রিয়তার সমান হলেও, জানুয়ারিতে দ্বিতীয় মেয়াদ শুরুর সময়কার ৪৭ শতাংশ সমর্থনের তুলনায় কম।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সময়ের সঙ্গে প্রেসিডেন্টদের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। জো বাইডেন ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ৫৫ শতাংশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, যা একই বছরের অক্টোবরেই নেমে আসে ৪৬ শতাংশে।
বিক্ষোভের এই ঢেউ যুক্তরাষ্ট্রের গভীর রাজনৈতিক বিভাজনকে আবারও সামনে এনেছে—যেখানে একপক্ষ “গণতন্ত্র রক্ষায়” রাস্তায় নেমেছে, আর অপরপক্ষ অভিযোগ করছে, এটি “রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র।” তবুও শনিবারের মতো শান্তিপূর্ণ গণসমাবেশ আমেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা দিয়ে গেছে।
মন্তব্য করুন