logo
  • রোববার, ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ৪ কার্তিক ১৪৩২

কি কারনে পাকিস্তান ধর্মীয় দল টিএলপির বিরুদ্ধে নতুন দমন অভিযান পরিচালনা করছে

আল জাজিরা

  ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ১০:০৭

দেশটির সর্বাধিক জনবহুল প্রদেশ পাঞ্জাবের সরকার চরমপন্থী ধর্মীয় দল তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তান (টিএলপি)-কে নিষিদ্ধ ঘোষণার জন্য ফেডারেল সরকারের অনুমোদন চাইছে। সপ্তাহজুড়ে টিএলপি কর্মীদের বিরুদ্ধে সহিংস দমন অভিযানের প্রেক্ষাপটে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের ভাগ্নি ও পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী মরিয়ম নবাজ শরিফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে কর্মকর্তারা “ঐতিহাসিক ও ব্যতিক্রমী” কিছু সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেন। যদিও মুখ্যমন্ত্রী টিএলপির নাম উল্লেখ করেননি, তার কার্যালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, “একটি চরমপন্থী দলকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং যারা সহিংসতা উসকে দিচ্ছে, ঘৃণা ছড়াচ্ছে বা আইন লঙ্ঘন করছে, তাদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করা হবে।”

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ওই দলের নেতৃত্বকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের “চতুর্থ তালিকায়” অন্তর্ভুক্ত করা হবে—যেখানে সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় জড়িত সন্দেহভাজনদের নাম থাকে।

সোমবার ভোরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বৃহৎ অভিযান পরিচালিতর্ করে। লাহোর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরের মুরিদকে এলাকায় টিএলপির প্রতিবাদ শিবির ভেঙে দেওয়ার পর এই ঘোষণা দেয়া হয়। ।

মে মাসে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার লক্ষ্যবস্তু হওয়া একই শহর মুরিদকে আবার আলোচনায় আসে। এবার অভিযানে ২,৭০০ জনেরও বেশি টিএলপি সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং আরও ২,৮০০ জনের নাম দেশত্যাগ নিষেধাজ্ঞা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

টিএলপি অতীতে ধর্মনিন্দা ইস্যুতে বহু সহিংস আন্দোলন পরিচালনা করেছে এবং সংখ্যালঘু, বিশেষত খ্রিস্টান ও আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে সংগঠনটির বিরুদ্ধে।

কেন প্রতিবাদে নামল টিএলপি

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২৯ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে পাশে রেখে গাজা যুদ্ধের অবসানে ২০ দফা পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। ১৩ অক্টোবর পাকিস্তানসহ কয়েকটি দেশ পরিকল্পনাটির অনুমোদন দেয়।

প্রস্তাবে বলা হয়, গাজায় যুদ্ধ অবিলম্বে বন্ধ হবে, হামাসের হাতে থাকা সব বন্দিকে (জীবিত বা মৃত) ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ফেরত দেওয়া হবে এবং ইসরায়েল গাজা উপত্যকা দখল করবে না। তবে এতে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কোনো স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি ছিল না—যা পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দাবি।

এই পরিকল্পনাকে “ফিলিস্তিনিদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করার ষড়যন্ত্র” আখ্যা দিয়ে টিএলপি “আল-আকসা গাজা মার্চ” ঘোষণার মাধ্যমে প্রতিবাদে নামার ঘোষণা দেয়। ১০ অক্টোবর লাহোর থেকে ইসলামাবাদ পর্যন্ত পদযাত্রা করে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভের পরিকল্পনা ছিল দলটির।

কীভাবে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে

গত শুক্রবার লাহোরে হাজারো কর্মীর সমাবেশে টিএলপি প্রধান সাদ হুসাইন রিজভি কর্তৃপক্ষের বাধা অগ্রাহ্য করে মার্চ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। পুলিশ প্রধান মহাসড়কে কনটেইনার বসিয়ে ও খাল খুঁড়ে পথ অবরুদ্ধ করলেও দলীয় কর্মীরা সংঘর্ষ পেরিয়ে রোববার মুরিদকে পৌঁছে যায়।

পুলিশের দাবি, সংঘর্ষে কয়েক ডজন পুলিশ সদস্য আহত হন। স্থানীয় সাংবাদিক এহতেশাম শামি জানান, মুরিদকে ও আশপাশে বিপুল সংখ্যক নিরাপত্তা সদস্য মোতায়েন থাকায় অভিযান চালানো হবে—এটি টিএলপি নেতাদের আগেই জানানো হয়েছিল।

রাত ২টার দিকে পুলিশ অভিযান শুরু করে, টিয়ার গ্যাস ছোড়ে এবং কয়েক ঘণ্টা ধরে সংঘর্ষ চলমান থাকে। অন্যদিকে টিএলপির দাবি, তারা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করছিল এবং পুলিশ অপ্রয়োজনীয় সহিংসতা চালায়। পাঞ্জাব পুলিশ জানায়, অভিযানে একজন পুলিশ সদস্য নিহত এবং বহুজন আহত হয়েছেন।

মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক

সরকারি হিসেবে তিনজন টিএলপি সদস্য নিহত হলেও দলটির দাবি—“শতাধিক কর্মী মারা গেছে এবং কর্তৃপক্ষ মৃতদেহ সরিয়ে ফেলেছে।” পাকিস্তানের প্রধান বিরোধী দল পিটিআইয়ের কয়েকজন নেতা টিএলপির এই দাবি সমর্থন করেন। যদিও টিএলপি তাদের দাবির স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করে নি।

তবে সাবেক তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী আল জাজিরাকে বলেন, “আমি লাহোরের আশপাশের দুই ডজন স্থানীয় নেতার সঙ্গে কথা বলেছি, কিন্তু একজন ছাড়া আর কেউ কোনো মৃত্যুর খবর দেননি।”


টিএলপি কী ধরনের দল

তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তান (টিএলপি) ২০১৫ সালে খাদিম হুসাইন রিজভি প্রতিষ্ঠা করেন। এটি দক্ষিণ এশিয়ার ব্রেলভি ধারার সুন্নি ইসলাম অনুসারী এক রাজনৈতিক আন্দোলন, যা ধর্মনিন্দার অভিযোগে অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে পরিচিত হয়ে ওঠে।

২০১১ সালে পাঞ্জাবের গভর্নর সালমান তাসিরকে হত্যাকারী মুমতাজ কাদরির পক্ষে প্রকাশ্য সমর্থনের পর দলটি জাতীয়ভাবে আলোচনায় আসে।

২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে টিএলপি প্রায় ২০ লাখ ভোট পেলেও জাতীয় সংসদে কোনো আসন পায়নি। তবে প্রাদেশিক পর্যায়ে কয়েকটি আসন জিতেছিল দলটি।

ধর্মনিন্দা পাকিস্তানে অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। ১৯৯০ সালের পর থেকে অন্তত ৮৫ জন ধর্মনিন্দার অভিযোগে নিহত হয়েছেন, এবং ২০২৩ সালের হিসাবে ৫৩ জন এই অভিযোগে আটক রয়েছেন। টিএলপি প্রায়ই আহমদিয়া সম্প্রদায়ের উপাসনালয় ও কবরস্থান ভাঙচুরের অভিযোগে অভিযুক্ত।

রিজভি ভ্রাতৃদ্বয়ের অবস্থান

সোমবারের অভিযানের পর দলীয় নেতা সাদ ও আনাস হুসাইন রিজভি নিখোঁজ রয়েছেন। গুজব ছড়ালেও পুলিশ জানিয়েছে, তারা নিহত হননি। লাহোর পুলিশের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, “আমরা তাদের অবস্থান শনাক্ত করেছি, শিগগিরই গ্রেপ্তার করা হবে।”

সাংবাদিক শামির মতে, হয়তো কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত তাদের গ্রেপ্তারের ঘোষণা বিলম্বিত করছে, যাতে কর্মীরা উত্তেজিত না হয়।

সিঙ্গাপুরের এস. রাজারত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের গবেষক আবদুল বাসিত বলেন, “টিএলপি মূলত ধর্মনিন্দা ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাজনীতি করত। এবার তারা ভিন্ন বিষয়ে নেমে ভুল হিসাব করেছে।”

অন্যদিকে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মুহাম্মদ আমির রানা বলেন, “পূর্বের আন্দোলনগুলোতে টিএলপি সহিংসতা চালিয়েও দায়মুক্তি পেয়েছিল। এবার রাষ্ট্রীয় সমর্থনে পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।”

সাবেক মন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী বলেন, “যারা ধর্মনিন্দার অভিযোগে মানুষের মাথা কেটে ফেলার স্লোগান দেয়, সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি পোড়ায়—তাদের কি রাজনীতিতে স্থান থাকা উচিত?”

বিশ্লেষকদের মতে, গাজা ইস্যুতে টিএলপির প্রতিবাদ জনগণের মধ্যে প্রত্যাশিত সাড়া পায়নি। অধিকাংশ পাকিস্তানি ধর্মীয় দল শুধু ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানালেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সরাসরি আন্দোলন করেনি। রানা বলেন, “সম্ভবত টিএলপি তাদের জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিল, তাই নজর কাড়তেই এই প্রতিবাদের আয়োজন করে।” বাসিতের মতে, “দলটি নিজের সমর্থক ঘাঁটিকে সক্রিয় করতে চেয়েছিল, কিন্তু জনসমর্থন পায়নি। তাই এই আন্দোলন তাদের একক প্রচেষ্টাতেই সীমিত ছিল।”

টিএলপির বিরুদ্ধে চলমান দমন অভিযানে পাকিস্তান সরকার কঠোর অবস্থান নিচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি শুধু নিরাপত্তা ইস্যু নয়, বরং রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা।

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
আরও পড়ুন
‘নো কিংস’ আন্দোলন জনসমুদ্রে পরিণত: ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল যুক্তরাষ্ট্র
দোহা বৈঠকের পর আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত
পাকিস্তানে ‘কমান্ড্যান্টস ওভারসিজ মেডেল’ পেলেন বাংলাদেশি ক্যাডেট জান্নাতুল মাওয়া
পাকিস্তানের বিমান হামলায় আফগানিস্তানে ১০ জন নিহত, যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের অভিযোগ
12