‘ইত্যাদি’ এবার কুড়িগ্রামের উলিপুরে

নব্বইয়ের দশক থেকেই জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’ স্টুডিওর বাইরে গিয়ে দেশের নানা প্রান্তে আয়োজন করে আসছে এর পর্বগুলো। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, প্রত্নসম্পদ ও জনজীবনের বিভিন্ন দিক দর্শকদের সামনে তুলে ধরা ইত্যাদির মূল লক্ষ্য। সেই ধারাবাহিকতায় এবারের পর্ব ধারণ করা হয়েছে সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রামে, যা নদীবেষ্টিত পলিগঠিত ভূমি, ভাওয়াইয়া সংগীত ও সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য সুপরিচিত। অনুষ্ঠানের মঞ্চ নির্মাণ করা হয় প্রায় দেড় শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী উলিপুর মহারানি স্বর্ণময়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে।

ধারণের দিন জুড়ে কুড়িগ্রামে ছিল উৎসবের আমেজ। দুপুরের পর থেকেই দর্শকরা আসতে শুরু করেন অনুষ্ঠানস্থলে। জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বিতরণ করা হয় বিশেষ আমন্ত্রণপত্র, আর নির্ধারিত সময়ের আগেই স্থানটি কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও বয়সের মানুষ উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে। জায়গা না পেয়ে অনেকেই বিদ্যালয়ের ছাদ, গাছ ও রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রখর গরম উপেক্ষা করেও উপভোগ করেন প্রিয় অনুষ্ঠানটি। স্থানীয়দের মতে, কুড়িগ্রামে আগে কখনও কোনো অনুষ্ঠানে এত দর্শক সমাগম দেখা যায়নি। শুধু উলিপুর নয়, রংপুর, লালমনিরহাট ও গাইবান্ধা থেকেও বহু মানুষ এসেছিলেন ইত্যাদি দেখতে।

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রাণের সংগীত ভাওয়াইয়া কুড়িগ্রামের মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই এবারের পর্বজুড়েই ভাওয়াইয়া গান, তার ঐতিহ্য ও ইতিহাস নানাভাবে স্থান পেয়েছে—নাটিকায়, প্রতিবেদনে, গানে এবং নিয়মিত পরিবেশনায়।

এই পর্বে দুটি গান রয়েছে। শুরুতেই মনিরুজ্জামান পলাশের কথায় কুড়িগ্রামের কৃষ্টিকথা ও ইতিহাস নিয়ে একটি পরিচিতিমূলক গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশিত হয়, যেখানে অংশ নেন স্থানীয় অর্ধশতাধিক নৃত্যশিল্পী। নৃত্য নির্দেশনা দিয়েছেন এস কে জাহিদ, কণ্ঠ দিয়েছেন রাজিব ও তানজিনা রুমা, সুর করেছেন হানিফ সংকেত এবং সংগীতায়োজন করেছেন মেহেদী।
দ্বিতীয় গানে নতুনভাবে পরিবেশিত হয়েছে আব্বাসউদ্দীনের অমর সৃষ্টি ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই’, যা গেয়েছেন জনপ্রিয় লোকশিল্পী সালমা আক্তার ও উত্তরাঞ্চলের ভাওয়াইয়া শিল্পী পূর্ণচন্দ্র রায়। গানটির সংগীতায়োজনও করেছেন মেহেদী।

দর্শকপর্বে কুড়িগ্রামকে ঘিরে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে নির্বাচিত চারজন দর্শক অংশ নেন ভাওয়াইয়া সংগীতভিত্তিক বিশেষ পর্বে। এই অংশে সহযোগিতা করে বাংলাদেশ ভাওয়াইয়া একাডেমির যন্ত্রশিল্পীবৃন্দ।

সব সময়ের মতো এবারের ইত্যাদিতেও তুলে ধরা হয়েছে জনকল্যাণে নিবেদিত মানুষ ও অজানা-অচেনা অঞ্চল নিয়ে তথ্যভিত্তিক প্রতিবেদন। রয়েছে কুড়িগ্রামের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা—মহারাণী স্বর্ণময়ী, মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর বাড়ি, বীর প্রতীক তারামন বিবি, চিলমারী নদীবন্দর, এবং মুক্তিযুদ্ধে কুড়িগ্রামের অবদান নিয়ে প্রতিবেদন।
এছাড়া, ভাওয়াইয়া চর্চা ও প্রচারের লক্ষ্যে প্রখ্যাত শিল্পী ভূপতি ভূষণ বর্মা প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ভাওয়াইয়া একাডেমি এবং ভাওয়াইয়া সংগীতের ঐতিহ্য নিয়ে রয়েছে বিশেষ প্রতিবেদন। শিল্পী ভূপতি ভূষণ বর্মা ও তাঁর শিক্ষার্থীরাও এতে একটি ভাওয়াইয়া গান পরিবেশন করেন।

২০১১ সালের জুলাই মাসে প্রচারিত এক পর্বে ইত্যাদি কুড়িগ্রামের কর্মউদ্যোগী যুবক আব্দুল কাদেরের ওপর প্রতিবেদন প্রচার করেছিল; এবারের পর্বে রয়েছে তারই ফলোআপ। পাশাপাশি কুড়িগ্রামের প্রায় চার শতাধিক চরাঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা ও সম্ভাবনা নিয়ে আছে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন।
আরও আছে মানবিক প্রতিবেদন—চিলমারীতে রিকতা আখতার বানু (লুৎফা) প্রতিষ্ঠিত বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে।

বিদেশি প্রতিবেদনে দেখানো হবে আধুনিক স্থাপত্য ও মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সিঙ্গাপুরের দুই দ্বীপ—সেন্ট জনস আইল্যান্ড ও কুসু আইল্যান্ড।

এছাড়া রয়েছে ‘কাশেম টিভির’ সাংবাদিক ও নাতির হাস্যরসাত্মক আলাপন, নিয়মিত চিঠিপত্র পর্ব, এবং সামাজিক অসংগতি ও সমসাময়িক প্রসঙ্গনির্ভর একাধিক নাট্যাংশ—উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে, বিজ্ঞের ভাব ধরা অজ্ঞ, ভাইরাল ভাইরাস, ঝাপসা ব্যবসা, দায়বোধ বনাম আয়বোধ, উপহার উৎপাত প্রভৃতি।

অভিনয়ে অংশ নিয়েছেন—সোলায়মান খোকা, আব্দুল আজিজ, আবদুল্লাহ রানা, সুভাশিষ ভৌমিক, জিল্লুর রহমান, মুকিত জাকারিয়া, আমিন আজাদ, শাহেদ আলী, আশরাফুল আলম সোহাগ, তারিক স্বপন, নিপু, আবু হেনা রনি, শাওন মজুমদার, সাবরিনা নিসা, জামিল হোসেন, রিমু রোজা খন্দকার, সাদিয়া তানজিন, সুজাত শিমুল, হানিফ পালোয়ান, নজরুল ইসলাম, সূচনা শিকদার, রাজীব সালেহীন, বেলাল আহমেদ মুরাদসহ আরও অনেকে।
মঞ্চ পরিকল্পনা ও শিল্প নির্দেশনায় ছিলেন নিয়মিত শিল্প নির্দেশক মুকিমুল আনোয়ার মুকিম।

ইত্যাদির এই বিশেষ পর্বটি প্রচারিত হবে ৩১ অক্টোবর, শুক্রবার, রাত ৮টার বাংলা সংবাদের পর বাংলাদেশ টেলিভিশনে।
রচনা, পরিচালনা ও উপস্থাপনা করেছেন হানিফ সংকেত। অনুষ্ঠানটি নির্মাণ করেছে ফাগুন অডিও ভিশন।