বাংলাদেশের কন্যারা ঝুঁকির মুখে: বাড়ছে শিশু ধর্ষণ ও সহিংসতা

এ বছর আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবসের প্রতিপাদ্য— “The girl I am, the change I lead: Girls on the frontlines of crisis”। এটি একদিকে কন্যাদের সাহস ও নেতৃত্বের স্বীকৃতি, অন্যদিকে সতর্কবার্তা। কারণ, সংকটের সময়ে তারাই সবচেয়ে বেশি আঘাত পায়, আবার তারাই প্রথম উঠে দাঁড়ায়।
কিন্তু বাংলাদেশে কন্যাশিশুদের বাস্তবতা ভয়াবহ। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে শিশুকন্যাদের ওপর ধর্ষণ ও সহিংসতা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে।
গাজীপুরে পূজা মণ্ডপের পাশে খেলা করা আট বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করে এক বৃদ্ধ। ময়মনসিংহে অটোরিকশা চালক ধর্ষণ করেছে ১৫ বছরের গারো কন্যাকে। শরীয়তপুরে নিখোঁজ ছয় বছরের এক শিশুর মরদেহ মিলেছে সেপটিক ট্যাংকে— ধর্ষণের পর খুন করা হয় তাকে।
এসব আলাদা ঘটনা নয়, বরং সারাদেশে বাড়তে থাকা সহিংসতার প্রতিচ্ছবি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের প্রথম নয় মাসে কন্যাশিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে ৮৩ শতাংশ— গত বছরের ১৯৫ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫৭-এ। ধর্ষণচেষ্টা বেড়েছে ১৬৩ শতাংশ, যৌন হয়রানি ৭৬ শতাংশ।
জাতীয় কন্যাশিশু অধিকার সংরক্ষণ ফোরামের (NGCAF) তথ্যে দেখা যায়, এ বছরের প্রথম আট মাসে অন্তত ৩৯০ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে এবং ১৩৪ জনের ওপর ধর্ষণচেষ্টা চালানো হয়েছে। এ সময় ৮৩ জন কন্যাশিশু খুন হয়েছে।
পুলিশের হিসাব আরও ভয়ংকর। জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে ধর্ষণ মামলা হয়েছে ৩,৫৮৯টি— এর মধ্যে ১,১৭২টি ভুক্তভোগী অপ্রাপ্তবয়স্ক।
জরুরি সেবা ৯৯৯-এ এ সময় “নারী ও শিশু নির্যাতন” সংক্রান্ত ২৫,০০০-এর বেশি কল এসেছে। এর মধ্যে ৯০৩টি ধর্ষণ, ৫০৪টি ধর্ষণচেষ্টা, ৭০৪টি স্টকিং ও ৬৫৬টি যৌন হয়রানির অভিযোগ ছিল।
সামাজিক সেবা অধিদপ্তরের ২৪ ঘণ্টার হেল্পলাইন ১০৯৮ একই সময়ে ২৯,০০০-এর বেশি নির্যাতনসংক্রান্ত কল পেয়েছে। তাদের সহায়তায় বন্ধ হয়েছে ১,১৩৭টি বাল্যবিবাহ, দেওয়া হয়েছে আইনি ও মানসিক সহায়তা।
তরুণ ভুক্তভোগী, তরুণ অপরাধী
মহিলা পরিষদের আগস্ট ২০২৫ সালের প্রতিবেদন বলছে, অধিকাংশ ভুক্তভোগীই ১৮ বছরের নিচে। অভিযুক্তদের বড় অংশও তরুণ— প্রায় এক-তৃতীয়াংশের বয়স ১১–৩০ বছরের মধ্যে।
সংগঠনটির কর্মকর্তা আফরোজা আরমান বলেন, “এত বেশি তরুণ অপরাধে জড়ানো উদ্বেগজনক। স্কুলপড়ুয়া মেয়েরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, আইন থাকলেও বাস্তব প্রতিরোধে ঘাটতি রয়ে গেছে। ঘরের ভেতর, প্রতিবেশীর বাড়ি বা পথে— কোথাও নিরাপদ নয় শিশুরা।
হেল্পলাইন ১০৯৮-এর ম্যানেজার চৌধুরী মো. মহাইমেন বলেন, “অভিভাবকদের অভিযোগ, সন্তানরা অমনোযোগী হয়ে পড়ছে, কিন্তু সমস্যা আসলে যোগাযোগের ঘাটতি ও প্রযুক্তির প্রভাব।”
মহিলা পরিষদের সভাপতি ড. ফওজিয়া মসনেম বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থায় নারী ও শিশুদের প্রতি সম্মান শেখানোর জায়গা নেই। “সমতা ও সম্মতির শিক্ষা না থাকায় কিশোরদের মধ্যে নারীবিদ্বেষ জন্ম নিচ্ছে।”
সরকার নতুন ৩০৯ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে— “নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে সমন্বিত সেবা জোরদার ও দ্রুত সাড়া কার্যক্রম”। এর আওতায় ইউনিয়ন থেকে জেলা পর্যায়ে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দল গঠন করা হবে, যারা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সহায়তা দেবে— চিকিৎসা, ফরেনসিক, আইনি ও মানসিক সেবা সহ।
মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব ড. প্রকাশ কান্তি চৌধুরী জানান, এই প্রকল্পে প্রতিরোধমূলক কাজেও গুরুত্ব দেওয়া হবে— স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও সামাজিক মাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হবে।
বাংলাদেশের কন্যারা প্রতিদিন লড়ছে ভয়, বৈষম্য ও সহিংসতার বিরুদ্ধে। তবু তারা থেমে নেই। এই লড়াই শুধু টিকে থাকার নয়— নিজের ভবিষ্যৎ নতুন করে লেখারও।
বি: দ্র: আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস উপলক্ষে ডেইলি স্টার পত্রিকার ফিচার রিপোর্ট থেকে অনুবাদ করা হয়েছ।
মন্তব্য করুন