logo
  • মঙ্গলবার, ০৪ নভেম্বর ২০২৫, ১৯ কার্তিক ১৪৩২

ঢাকায় জন্ম নেওয়া চলচ্চিত্রকার বদলে দিয়েছিলেন ভারতীয় সিনেমার ভাষা

অনলাইন ডেস্ক
  ০৪ নভেম্বর ২০২৫, ১১:২৪
ছবি: সংগৃহীত

উষ্কখুষ্ক চুল, পাঞ্জাবির ওপর খোলা বোতামের খাদির জ্যাকেট, কাঁধে ঝোলা আর দুটো জ্বলজ্বলে চোখ—চেনা এই চেহারা দেখলেই বোঝা যায়, তিনি ঋত্বিক ঘটক। মাত্র ৫০ বছরের জীবনে তিনি বানিয়েছেন আটটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, কিন্তু তাঁর সিনেমার অভিঘাত ছড়িয়ে পড়েছে দেশ ছাড়িয়ে, বিশ্বজুড়ে। মৃত্যুর পরই যেন পৃথিবী নতুন করে আবিষ্কার করেছে এই নির্মাতাকে। আজ, ৪ নভেম্বর, ঢাকায় জন্ম নেওয়া এই বিরল প্রতিভার জন্মশতবার্ষিকী।

১৯২৫ সালটি সিনেমাপ্রেমীদের কাছে বিশেষ এক বছর—ঋত্বিক ঘটকের জন্ম, আইজেনস্টাইনের ব্যাটলশিপ পোটেমকিন ও চার্লি চ্যাপলিনের দ্য গোল্ড রাশ মুক্তির বছর। তবে আজ কথা শুধু ঋত্বিকের—ঢাকার সেই ছেলেটি, যিনি ভারতীয় সিনেমার ভাষা বদলে দিয়েছিলেন। যখন অন্য নির্মাতারা পশ্চিমা ধাঁচে সংযত আবেগ প্রকাশের পথে হাঁটছিলেন, ঋত্বিক তখন নিজস্ব পথে, ভারতীয় মেলোড্রামাকে ফোক, ক্ল্যাসিক্যাল, পুরাণ আর জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি করেছিলেন এক অনন্য ভাষা।

১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকার জিন্দাবাহার লেনে জন্ম ঋত্বিকের। জন্মের সাত মিনিট পরই পৃথিবীতে আসেন তাঁর যমজ বোন প্রতীতি দেবী। বাবা সুরেশচন্দ্র ঘটক ও মা ইন্দুবালা দেবীর নয় সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন এই দুই ভাইবোন। সাহিত্য, সংগীত, নাটক, আলোকচিত্র—সবকিছুর চর্চা ছিল তাঁদের পরিবারে। প্রতীতি দেবী পরে লিখেছিলেন, “আমাদের পরিবারে শিক্ষা ও সংস্কৃতির মূল্য ছিল অত্যন্ত উঁচু।” ঘরে ঘরেই নাটক হতো, পরিবারের সদস্যরাই অংশ নিতেন তাতে।

কৈশোরেই নিপীড়িত মানুষের প্রতি সহমর্মিতা গড়ে ওঠে ঋত্বিকের মধ্যে। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে পড়ার সময় এক মানসিক আঘাত তাঁকে নাড়া দেয়। পরে পরিবারের সিদ্ধান্তে পাঠানো হয় কানপুরের এক কারিগরি স্কুলে। সেখানে শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকদের কষ্ট, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, শোষণ—সব দেখেছিলেন কাছ থেকে। অল্প বয়সেই অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে শ্রমিকদের সংগঠিত করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তেজনা শুরু হলে তাঁকে ফিরিয়ে আনা হয়। এরপর ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা আর দেশভাগ—এই দুই অভিজ্ঞতা তাঁর জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে, যা পরবর্তীকালে ফিরে এসেছে তাঁর প্রায় প্রতিটি সৃষ্টিতে।

দেশভাগের বেদনা আজও পুরোপুরি প্রকাশ পায়নি, কিন্তু ঋত্বিকের সিনেমাগুলো সেই শূন্যতা পূরণ করেছে। যন্ত্রণা, প্রতিবাদ আর মানবিকতার মিশেলে তিনি তৈরি করেছেন অমর ভাষা। সুবর্ণরেখায় যেমন উদ্বাস্তুদের নবজীবনের স্বপ্নের সঙ্গে যুক্ত করেছেন করুণ বাস্তবতা—এক প্রজন্মের হারানো স্বপ্ন ও পরবর্তী প্রজন্মের নতুন আশার চক্র যেন ফুটে উঠেছে সেখানে।

অবিভক্ত বাংলার প্রাকৃতিক ভূগোল ঋত্বিকের শিল্পবোধের কেন্দ্রস্থলে ছিল। দেশভাগে মাতৃভূমি হারানো মানুষের বেদনা তিনি দেখেছেন নিজের চোখে। নাগরিক–এর রামু ও উমার চরিত্র, দেশভাগ–পরবর্তী কলকাতায় তাঁদের আনন্দময় ভবিষ্যৎ স্বপ্ন, সবই আসে ফেলে আসা স্মৃতি থেকে। আবার অযান্ত্রিক–এ কোনো রাজনৈতিক বিভাজন না থাকলেও তিনি সেখানে মানুষ, যন্ত্র আর প্রকৃতির সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

সুবর্ণরেখায় বাউলের দল হয়ে ওঠে অখণ্ড বাংলার প্রতীক; তাদের গান, ধর্মনিরপেক্ষ জীবন ও সীমান্তভেদী বার্তা সিনেমাকে দেয় অন্য মাত্রা। আর কোমল গান্ধার–এর সেই বিখ্যাত বাফার শট—পরিত্যক্ত রেললাইন, ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে অনন্ত যাত্রার রূপক—কে ভুলতে পারে!

সত্যজিৎ রায় তাঁর সিনেমা অ্যান্ড আই বইয়ে লিখেছিলেন, “ঋত্বিক দুর্ভাগ্যবশত জীবদ্দশায় দর্শকের দ্বারা উপেক্ষিত হয়েছিলেন। কেবল মেঘে ঢাকা তারা কিছুটা সাড়া পেয়েছিল। অথচ তাঁর মতো আবেগের গভীরতা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা ভারতীয় সিনেমায় বিরল।”

অত্যন্ত সীমিত বাজেটেও তিনি সৃষ্টি করেছিলেন অনন্য ভিজ্যুয়াল ভাষা ও সাউন্ড ডিজাইন। অযান্ত্রিক–এ একটি গাড়িকেও তিনি জীবন্ত চরিত্রে পরিণত করেছেন, আর সুবর্ণরেখামেঘে ঢাকা তারায় অতিনাটকীয়তা ব্যবহার করে দৃশ্যকে দিয়েছেন হৃদয়বিদারক উচ্চতা। তাঁর সংলাপ, যেমন “এখানে প্রজাপতি পাওয়া যায়, এখানে সূর্য ওঠে”—একসময়কার নিষ্পাপ স্মৃতি ও হারানো সময়ের প্রতীক হয়ে ওঠে।

ঋত্বিকের ইমপ্রোভাইজেশন ছিল অবিশ্বাস্য। সুবর্ণরেখা–র বিমানঘাঁটির ভিখারি দৃশ্যে তিনি রবীন্দ্রসংগীত “আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায়”-এর সঙ্গে মিলিয়েছিলেন রামায়ণ–এর আখ্যান। চলচ্চিত্রতাত্ত্বিক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের মতে, ঋত্বিক সিনেমাকে কেবল বিনোদন নয়, ইতিহাস ও মানুষের শিকড়ের সঙ্গে পুনরায় যুক্ত হওয়ার মাধ্যম হিসেবে দেখেছিলেন।

তাঁর ছবিগুলো ছিল সেইসব মানুষের প্রতিচ্ছবি, যাদের বিভাজন ছিন্ন করেছে—যারা হারিয়েছে শুধু ঘর নয়, নিজেদের পরিচয়ও। মেঘে ঢাকা তারায় দেবীর মতো নীতা যেন সেই উৎসর্গিত নারী, যিনি সমগ্র জাতির যন্ত্রণা ধারণ করেন।

সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ত্রিদিব পোদ্দার বলেন, “ঋত্বিক আমাদের ঐতিহ্য রেখে গেছেন, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর প্রায় অর্ধশতক পরও আমরা আরেকজন ঋত্বিক পাইনি।”

অনেকে তাঁকে মৃণাল সেনের সঙ্গে তুলনা করলেও, ত্রিদিব পোদ্দার মনে করেন, “ঋত্বিকের রাজনীতি ছিল তাঁর শিল্পের প্রাণ; তিনি ‘রাজনৈতিক নির্মাতা’ নন, বরং মানবিকতার দার্শনিক।”

বাংলাদেশে তিনি নির্মাণ করেছিলেন একটিমাত্র চলচ্চিত্র—তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩)। অদ্বৈত মল্লবর্মণের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন প্রবীর মিত্র, রোজী সামাদ, কবরী, গোলাম মুস্তাফা, আবুল হায়াত প্রমুখ। নদীতীরবর্তী মালো সম্প্রদায়ের জীবন, সম্পর্ক, ভাঙন ও পুনর্জন্মের কাহিনি এটি। ঋত্বিক নিজেই বলেছিলেন, “‘তিতাস’ পূর্ব বাংলার একখণ্ড জীবন—একটি সৎ লেখা, নাটকীয়, সুরেলা, আর গভীর মানবিক।”

২০০৭ সালে ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের জরিপে ‘তিতাস’ নির্বাচিত হয় বাংলাদেশের সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে। অথচ জীবদ্দশায় কোনো বড় উৎসবে আমন্ত্রণ পাননি, কোনো পুরস্কারও নয়। বাণিজ্যিক ব্যর্থতার আড়ালে আজ তাঁর নামই প্রেরণা দেয় অসংখ্য নির্মাতাকে।

১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় তিনি প্রয়াত হন। কেউ কেউ বলেন, তিনি যদি মদ্যপান নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন, হয়তো আরও অনেক সিনেমা পেতাম আমরা। কিন্তু নিয়মের মধ্যে থাকলে তিনি হয়তো ঋত্বিক ঘটকই থাকতেন না।

যিনি মেঘে ঢাকা তারায় নীতার কণ্ঠে বলিয়েছিলেন—“দাদা, আমি বাঁচতে চাই”—সেই সংলাপ আজও আমাদের অন্তর কাঁপায়। জীবনের প্রতি সেই অদম্য আকাঙ্ক্ষা, সেই যন্ত্রণার সৌন্দর্য—এই তো ঋত্বিক ঘটক, এক জীবন, এক দর্শন, এক শাশ্বত প্রতিধ্বনি।

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
আরও পড়ুন
শাহরুখ খানের নতুন চলচ্চিত্র ‘কিং’-এর ট্রেলার প্রকাশ
দূরত্বে থেকেও ভালোবাসায় বাঁধা নেই—মৌসুমীর জন্মদিনে আবেগঘন বার্তা ওমর সানীর
দ্বিতীয়বারের মতো কলকাতার চলচ্চিত্র উৎসবে নেই বাংলাদেশের সিনেমা
অস্কারের পথে সৌদি নারী নির্মাতা শাহাদ আমিনের ‘হিজরা’
12