চায়ের দোকান থেকে তারকাখ্যাতি, ওম পুরির গল্প

চায়ের দোকান থেকে বলিউড—ওম পুরির জীবনের গল্প যেন সিনেমারই মতো।
শৈশবে চায়ের দোকানে থালা ধুতেন তিনি, আর স্বপ্ন দেখতেন ট্রেনচালক হওয়ার। কিন্তু ভাগ্যের লেখা ছিল অন্য কিছু—একদিন তিনিই হয়ে উঠবেন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা, যিনি বলিউড ও হলিউড—দুই দিকেই সমানভাবে আলো ছড়াবেন। আজ, ১৮ অক্টোবর, তাঁর জন্মদিন। ওম পুরির জীবনসংগ্রাম, অধ্যবসায় আর সাফল্যের অনুপ্রেরণামূলক কাহিনি আজও মানুষকে নাড়া দেয়।
১৯৫০ সালের ১৮ অক্টোবর পাঞ্জাবের পাতিয়ালায় জন্মগ্রহণ করেন ওম পুরি। তবে তাঁর পরিবার সঠিক জন্মতারিখ জানত না। মা বলতেন, দশেরার দিনেই তাঁর জন্ম। তাই ওম পুরি নিজেই ঠিক করেন—১৮ অক্টোবরই হবে তাঁর জন্মদিন। ছয় বছর বয়স থেকেই সংসারের দায় কাঁধে তুলে নিতে হয় তাঁকে। চায়ের দোকানে থালা ধোয়া, ছোটখাটো নানা কাজ—সবই করতেন তিনি। এমনকি একসময় তাঁর বাবা চুরির অভিযোগে জেলে গেলে সংসারের ভার আরও বেড়ে যায় ছোট্ট ওমের ওপর।
শৈশবেই ট্রেনের প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ ভালোবাসা। ট্রেনের ভেতরেই কখনো কখনো রাত কাটাতেন তিনি, স্বপ্ন দেখতেন একদিন ট্রেনচালক হবেন। কিন্তু জীবনের গতি মোড় নেয় অন্যদিকে—অভিনয়ের জগতে। নিজেকে গড়ার স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হন ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা (এনএসডি)-তে। সেখান থেকেই গড়ে ওঠে তাঁর অভিনয়ের ভিত, যা তাঁকে ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চেও পরিচিত করে তোলে।
দীর্ঘ ৪৫ বছরের অভিনয়জীবনে হিন্দি, ইংরেজি ও বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার অসংখ্য ছবিতে অভিনয় করেছেন ওম পুরি। সমান্তরাল শিল্পধারার সিনেমা থেকে শুরু করে ‘চাচি ৪২০’, ‘মকবুল’, ‘বজরঙ্গি ভাইজান’-এর মতো বাণিজ্যিক ছবিতেও তিনি সমানভাবে প্রশংসিত হয়েছেন।
যদি তাঁর দুটি উল্লেখযোগ্য সিনেমার নাম নিতে হয়, তবে ‘আক্রোশ’ ও ‘অর্ধ সত্য’ নিঃসন্দেহে থাকবে সবার আগে। এই দুই ছবিতেই তাঁর অভিনয়ের গভীরতা ভারতীয় সিনেমার নবতরঙ্গ আন্দোলনকে আরও দৃঢ় করেছে।
মারাঠি ছবি ‘ঘাসিরাম কোটওয়াল’-এর মাধ্যমে চলচ্চিত্রজীবনের শুরু হলেও, ১৯৮০ সালের ‘আক্রোশ’-এর মাধ্যমেই বলিউডে আসে তাঁর বড় সাফল্য। সমাজবাস্তবতার তীব্র প্রতিফলন দেখা যায় সেই ছবিতে, যা তাঁকে এনে দেয় ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্র অভিনেতার পুরস্কার। এরপর একের পর এক স্মরণীয় চরিত্র—‘আরোহণ’, ‘অর্ধ সত্য’, ‘জানে ভি দো ইয়ারোঁ’, ‘চাচি ৪২০’, ‘হেরা ফেরি’, ‘মালামাল উইকলি’—প্রতিটিতেই যেন তিনি নতুনভাবে নিজেকে আবিষ্কার করেছেন।
ভারতের বাইরেও ওম পুরির প্রতিভা ছড়িয়ে পড়ে। হলিউডের ‘সিটি অব জয়’, ‘উলফ’, ‘দ্য ঘোস্ট অ্যান্ড দ্য ডার্কনেস’-এর মতো চলচ্চিত্রেও তিনি অভিনয় করেন। বড় চরিত্র হোক বা ছোট, তাঁর উপস্থিতি ছিল সবসময়ই গভীর ও বাস্তব। চরিত্রকে জীবন্ত করে তোলাই ছিল তাঁর অভিনয়ের মূল শক্তি।
তিনি একবার বলেছিলেন,
“সিনেমার দুই রকম আছে—একটি শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য, অন্যটি হৃদয় ছুঁয়ে যায়। দুটিরই নিজস্ব গুরুত্ব আছে।”
২০১৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর, মৃত্যুর কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে ওম পুরি বলেছিলেন, “আমার অবদান তখনই স্পষ্ট হবে, যখন আমি আর থাকব না—যখন চলচ্চিত্র শিক্ষার্থীরা আমার সিনেমা দেখবে।”
ওম পুরি ছিলেন সমাজসচেতন ও বিকল্প ধারার সিনেমার সমর্থক। তিনি বলতেন, “আমার কাছে শক্তিশালী সিনেমা বলতে বোঝায় ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকের সেই সময়, যখন শ্যাম বেনেগাল, গোবিন্দ নিহালানি, বাসু চ্যাটার্জি, মৃণাল সেন, গুলজার অসাধারণ সব ছবি বানিয়েছিলেন।”
তিনি কখনো একরকম চরিত্রে আটকে থাকেননি—বরং জীবনের মতো বাস্তব চরিত্রগুলোকেই প্রাণ দিয়েছেন পর্দায়। নাসিরুদ্দিন শাহ, সাধু মেহের ও স্মিতা পাতিলের সঙ্গে তাঁর তুলনা প্রায়ই টানা হয় এই কারণেই।
সহজ-সরল জীবনযাপন করতেন ওম পুরি। সাংবাদিক বা দর্শকদের সঙ্গে মিশতেন স্বাভাবিকভাবে, কখনো তারকাসুলভ দূরত্ব রাখতেন না। অভিনয় ছিল তাঁর সাধনা, আর শিল্পের প্রতি ছিল গভীর ভালোবাসা।
ব্যক্তিজীবনে ছিল নানা উত্থান-পতন। দু’বার বিয়ে করেন—প্রথমে অভিনেত্রী সীমা কাপুরকে, পরে সাংবাদিক নন্দিতা পুরিকে। জীবনের কিছু বিতর্ক সংবাদ শিরোনাম হলেও, তাঁর কাজ সবসময় সেগুলোর ঊর্ধ্বে থেকেছে।
অভিনয়ে অসামান্য অবদানের জন্য পেয়েছেন বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননা। পাশাপাশি তিনি নতুন প্রজন্মের অভিনেতাদের জন্য হয়ে উঠেছিলেন প্রেরণার প্রতীক, এনএসডি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে তাঁদের অভিনয় শেখাতেনও।
২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি, হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে ৬৬ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান ওম পুরি।
তাঁর অভিনয় কৌশল, চরিত্রে বাস্তবতার ছোঁয়া—সবই আজও দর্শকদের মনে জাগিয়ে রাখে তাঁকে। কত সিনেমা করেছেন, কত পুরস্কার পেয়েছেন—সেগুলো হয়তো সময়ের সঙ্গে হারিয়ে যাবে, কিন্তু তাঁর অভিনয়ের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি চিরকাল বেঁচে থাকবে মানুষের হৃদয়ে।
মন্তব্য করুন