logo
  • সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫, ৫ কার্তিক ১৪৩২

অ্যাঞ্জেলিনা জোলি: ব্যক্তিগত বেদনা থেকে বিশ্বজনীন অনুপ্রেরণার পথে

অনলাইন ডেস্ক
  ২০ অক্টোবর ২০২৫, ১৫:০৯
ছবি: সংগৃহীত

অ্যাঞ্জেলিনা জোলির জীবন শুধু হলিউডের গ্ল্যামার আর খ্যাতির কাহিনি নয়, এটি এক সংগ্রামী নারীর জীবন্ত ইতিহাস—যেখানে ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি, শারীরিক যন্ত্রণা আর মানসিক লড়াই পেরিয়ে এক মানবিক আইকনে পরিণত হওয়ার গল্প লুকিয়ে আছে। সাম্প্রতিক চলচ্চিত্র ‘কাউচার’-এর মাধ্যমে জোলি যেন পর্দায় তুলে এনেছেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে বেদনাময় অধ্যায়টি।

জোলির ক্যান্সারের সঙ্গে সম্পর্ক শুরু হয় অনেক আগে, তাঁর কৈশোরে। তখনই তিনি দেখেছিলেন তাঁর মা মার্চেলিন বার্ট্রান্ডের ক্যান্সারের সঙ্গে সংগ্রাম। ২০০৭ সালে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে এই রোগেই মারা যান জোলির মা। তাঁর দাদিও একই রোগে প্রাণ হারান। পারিবারিক এই ইতিহাস জোলিকে জিনগত পরীক্ষা করাতে উদ্বুদ্ধ করে, আর তাতেই প্রকাশ পায় ভয়াবহ তথ্য—তাঁর শরীরে রয়েছে BRCA জিন মিউটেশন, যা তাঁর ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি ৮৭ শতাংশ এবং ওভারিয়ান ক্যান্সারের ঝুঁকি ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়।

এই তথ্য জানার পর ২০১৩ সালে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে জোলি নেন এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত—প্রিভেন্টিভ ডাবল মাস্টেক্টমি। ৯ ঘণ্টার জটিল সার্জারিতে তাঁর ব্রেস্ট টিস্যু সরিয়ে ফেলা হয় এবং ইমপ্লান্টের মাধ্যমে পুনর্গঠন করা হয়। নিউইয়র্ক টাইমসে তিনি লেখেন, “এই সিদ্ধান্ত আমাকে আরও শক্তিশালী ও আত্মবিশ্বাসী করেছে।”

এর দুই বছর পর, ২০১৫ সালে, ডাক্তাররা তাঁর ডিম্বাশয়ে ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ খুঁজে পান। এরপর জোলি করেন প্রিভেন্টিভ ওভারিয়েক্টমি—আরও এক সাহসী পদক্ষেপ। সেই সময় তিনি বলেছিলেন, “মনে হয়েছিল, পৃথিবী যেন আমার মাথার ওপর ভেঙে পড়ল।”

তাঁর এই সিদ্ধান্ত শুধু ব্যক্তিগত নয়, বিশ্বজুড়ে নারীস্বাস্থ্য সচেতনতার এক মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। পরবর্তীতে একে বলা হয় “অ্যাঞ্জেলিনা জোলি ইফেক্ট”—যার ফলে সারা বিশ্বে জিনেটিক টেস্টিং ও ব্রেস্ট ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ের হার কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

ফরাসি নির্মাতা অ্যালিস উইনোকুর পরিচালিত ‘কাউচার’ চলচ্চিত্রটি মূলত জোলির এই ব্যক্তিগত যাত্রারই শিল্পরূপ। ছবিতে ক্যান্সারে আক্রান্ত চরিত্রে অভিনয় করার সময় জোলি যেন নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতাকেই জীবন্ত করে তুলেছেন। তিনি বলেন, “এই চরিত্রে অভিনয় আমার কাছে গভীরভাবে আবেগী অভিজ্ঞতা ছিল। প্রতিটি নারী, যিনি ক্যান্সারের সঙ্গে লড়েছেন, তাঁদের জন্যই এই সিনেমা।” তাঁর জন্য ‘কাউচার’ ছিল একধরনের থেরাপি—একটি মাধ্যম, যার মাধ্যমে তিনি মায়ের স্মৃতি ও নিজের বেদনা রূপান্তরিত করেছেন শিল্পে, যা আজ কোটি নারীর অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে।

সিনেমাটির মূল সৌন্দর্য শুধু ক্যান্সারের গল্প নয়; বরং এক নারীর আত্মবিশ্বাস, সৃজনশীলতা আর জীবনের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ। প্রদর্শনীর শেষে দর্শকদের দাঁড়িয়ে অভিবাদন, সমালোচকদের প্রশংসা—সবই প্রমাণ করেছে, এটি জোলির ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা অভিনয়, যেখানে তাঁর বাস্তব জীবনের লড়াকু সত্তা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত।

সম্প্রতি ইতালির রোম চলচ্চিত্র উৎসবে ‘কাউচার’-এর প্রিমিয়ারে উপস্থিত হয়ে জোলি আবারও সবাইকে মুগ্ধ করেছেন। কালো ওপেন-ব্যাক গাউনে তাঁর পিঠজুড়ে নতুন ট্যাটুটি ছিল সন্ধ্যার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। কেউ একে তাঁর ‘পুনর্জন্ম’-এর প্রতীক বলছেন, কেউ দেখছেন তাঁর স্বাধীনসত্তার প্রকাশ হিসেবে। ফ্যাশন বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেছেন, “অ্যাঞ্জেলিনা আবারও প্রমাণ করলেন, ফ্যাশন তাঁর কাছে কেবল পোশাক নয়, এটি আত্মপ্রকাশের সাহসী ভাষা।”

উৎসবে তিনি নারীর স্বাস্থ্য, সহনশীলতা ও নিজের ব্যক্তিগত সংগ্রাম নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সহ-অভিনেতা লুই গ্যারেল, আনিয়ার আনে এবং নির্মাতা অ্যালিস উইনোকুর। তবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন শুধু জোলি—যিনি ৫১ বছর বয়সে জীবনের নতুন অধ্যায় লিখছেন। অভিনেত্রী, পরিচালক, ইউএনএইচসিআরের বিশেষ দূত এবং ছয় সন্তানের মা হিসেবে তাঁর প্রতিটি ভূমিকায় প্রতিফলিত সেই অদম্য শক্তিই তাঁকে আজকের অ্যাঞ্জেলিনা জোলিতে পরিণত করেছে।

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
12