রাজস্ব ঘাটতির দায়ে নুয়ে পড়েছে কোষাগার, ঋণচক্রে ঢুকছে দেশ

অর্থনীতি এখন তীব্র সংকটে। ব্যবসা-বাণিজ্যে চরম মন্দা, বিনিয়োগে ভাটা, ব্যাংক খাতে অস্থিরতা এবং লাগামছাড়া সুদের হার সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা নেমে এসেছে। এর জের ধরে পুঁজিবাজার ধসে পড়েছে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ভালো যাচ্ছে না। অর্থবছরের শেষ প্রান্তে এসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভেঙে ফেলার দাবিতে কর্মবিরতির কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
সরকারের অভ্যন্তরীণ আয় বলতে গেলে প্রায় থমকে গেছে। প্রত্যাশিত রাজস্ব না ওঠায় চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসেই ঘাটতির অঙ্ক ছাড়িয়েছে ১ লাখ কোটি টাকা। অথচ ব্যয় থেমে নেই, বরং বেড়েই চলেছে। ফলে সরকারকে দিন দিন আরও বেশি ঋণনির্ভর হতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকারের দায়দেনা ২৩ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। পরে তা কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হলেও সেই লক্ষ্যও পূরণ করতে ব্যর্থ এনবিআর। প্রতি মাসে আদায়ের গড় লক্ষ্য ছিল প্রায় ৩৮ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। কিন্তু মে মাস পর্যন্ত আদায় হয়েছে ৩ লাখ ২২ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা। নির্ধারিত লক্ষ্য থেকে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা। জুনে ঘাটতি পূরণ করতে হলে আদায় করতে হবে ১ লাখ ৪১ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা—যা প্রায় অসম্ভব।
রাজস্ব আয় কমে যাওয়ায় সরকার ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র এবং বিদেশি উৎস থেকে ধার করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০৩.৬৪ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১২ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। দেশীয় উৎস থেকে ঋণ আরও ১০ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে সরকারে ওপর ২৩ লাখ কোটি টাকার ঋণের চাপ।
বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, “ঘাটতি মেটাতে সরকারের সামনে ঋণ নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপালে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, আর ব্যাংক খাত থেকে নিলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যাবে। এতে সামষ্টিক অর্থনীতিতে চাপে পড়বে।”
সিপিডি'র বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “এই ঘাটতি অব্যাহত থাকলে আগামী বাজেটের কাঠামোই ভেঙে পড়বে। আয় না বাড়লে ব্যয় ও ঋণ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠবে। এতে দেশ ঋণচক্রে পড়ে যেতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “রাজস্ব আদায় বাড়াতে হলে আগে অর্থনীতিতে গতি ফিরিয়ে আনতে হবে। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ, সুশাসন, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এবং সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই।”
রাজস্ব খাতের এই সংকট নিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের এক কর্মকর্তা জানান, “রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণেই ভুল রয়েছে। তার ওপর ব্যবসায় মন্দা, সরকার পরিবর্তন, আমদানি ধস ও রাতারাতি অধ্যাদেশ জারি—সব মিলিয়ে এই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে নেতৃত্বে পরিবর্তন না আনলে সংকট আরও ঘনীভূত হবে।”
মন্তব্য করুন