গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২০, ইসরায়েলি বন্দির মৃতদেহ হস্তান্তর বিলম্বিত
গাজা উপত্যকার বিভিন্ন স্থানে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর তীব্র হামলায় অন্তত ২০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন । দক্ষিণ রাফাহ সীমান্তে গুলিবিনিময়ের পর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সেনাবাহিনীকে “শক্তিশালী পাল্টা আঘাত” চালানোর নির্দেশ দেন। গুলিবিনিময়ের ঘটনায় এক ইসরায়েলি সেনা আহত হন।
মঙ্গলবারের এই হামলা ছিল ১০ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতির পর সবচেয়ে বড় সহিংসতা।
হামাসের সামরিক শাখা আল-কাসাম ব্রিগেডস ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগে এনেছে এবং এক বন্দির মৃতদেহ হস্তান্তর বিলম্বিত করার ঘোষণা দিয়েছে। তারা সতর্ক করে বলেছে, ইসরায়েলের অব্যাহত হামলা “বন্দিদের দেহ উদ্ধার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করবে” এবং এতে গাজায় থাকা আরও ১৩ বন্দির মৃতদেহ উদ্ধারেও দেরি হতে পারে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের উপ–রাষ্ট্রপতি জেডি ভ্যান্স বলেছেন, হামলা সত্ত্বেও যুদ্ধবিরতি এখনো টিকে আছে। “এমন সংঘর্ষ ছিটেফোঁটা ঘটতে পারে,” তিনি বলেন। “আমরা জানি গাজা থেকে একজন ইসরায়েলি সেনাকে লক্ষ্য করে হামলা হয়েছে, এবং ইসরায়েল প্রতিক্রিয়া দেখাবে—তবুও প্রেসিডেন্টের শান্তি চুক্তি টিকে থাকবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।”
অন্যদিকে রাফাহর গুণিবিনিময়ের ঘটনায় হামাস নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে।
গাজার চিকিৎসা সূত্র জানায়, উত্তর গাজা সিটির সাবরা এলাকায় একটি আবাসিক ভবনে মঙ্গলবারের হামলায় চারজন নিহত হন। দক্ষিণের খান ইউনুসে মারা গেছেন আরও পাঁচজন। এ ঘটনায় অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
আল জাজিরার সাংবাদিক হানি মাহমুদ জানান, একটি ক্ষেপণাস্ত্র আল-শিফা হাসপাতালের পেছনে আঘাত হানে। “হাসপাতালের ভেতরে রোগী ও কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে,” তিনি বলেন। “বিস্ফোরণ এতই শক্তিশালী ছিল যে আমরা ২০ মিনিট দূর থেকেও শব্দ শুনতে পেয়েছি।”
সাবরা এলাকায় ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়া ফিলিস্তিনিদের উদ্ধারে রাতভর অভিযান চালায় উদ্ধারকর্মীরা। আহতদের মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে।
একজন সিভিল ডিফেন্স কর্মী ইব্রাহিম আবু রিশ বলেন, “এটি যুদ্ধবিরতির স্পষ্ট লঙ্ঘন। আমাদের দল এখনো ধ্বংসস্তূপের ভেতরে জীবিতদের উদ্ধারের চেষ্টা করছে।”
নেতানিয়াহুর দপ্তর থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী সেনাবাহিনীকে গাজায় “শক্তিশালী আঘাত হানার” নির্দেশ দিয়েছেন। তবে হামলার নির্দিষ্ট কারণ জানানো হয়নি। পরে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ বলেন, রাফাহর হামলার দায় হামাসের, এবং এর জন্য তারা “ভারি মূল্য দেবে”।
এসোসিয়েটেড প্রেস জানায়, ইসরায়েল গাজায় হামলা চালানোর আগে যুক্তরাষ্ট্রকে অবহিত করেছিল।
গাজার সরকারি মিডিয়া অফিসের দাবি, যুদ্ধবিরতির পর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৯৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং দেশটি এখনো মানবিক সহায়তা প্রদানে কড়াকড়ি আরোপ করছে।
হামাস বলেছে, ইসরায়েলের এই হামলা “শর্ম আল শেখে ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতির চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন”। তবে দলটি জানায়, তারা এখনো চুক্তিতে অঙ্গীকারবদ্ধ।
হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য সুহাইল আল-হিন্দি বলেন, “আমরা বন্দিদের দেহ উদ্ধারে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছি, কিন্তু ইসরায়েলের হামলাই দেরির জন্য দায়ী।”
কাসাম ব্রিগেডস জানায়, মঙ্গলবার তারা আরও দুই ইসরায়েলি বন্দির দেহ উদ্ধার করেছে — আমিরাম কুপার ও সাহার বারুখ।
এর আগে নেতানিয়াহু দাবি করেন, সোমবার হামাস যে দেহগুলো হস্তান্তর করেছে, সেগুলো ১৩ বন্দির মধ্যে কারও নয়; বরং প্রায় দুই বছর আগে ইসরায়েলি বাহিনী যাদের দেহ উদ্ধার করেছিল, তাদেরই দেহ ফেরত দেওয়া হয়েছে।
নেতানিয়াহুর ডানপন্থী মন্ত্রিসভা কঠোর প্রতিক্রিয়ার দাবি জানিয়েছে। অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোটরিচ মুক্ত বন্দিদের পুনরায় গ্রেপ্তারের আহ্বান জানান, আর জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির বলেন, “হামাসকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা ছাড়া বিকল্প নেই।”
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, মানবিক সহায়তা বন্ধ রাখা, গাজার ওপর আরও নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি বা হামাস নেতাদের টার্গেট করে বিমান হামলা চালানোর মতো পদক্ষেপ বিবেচনা করছে সরকার।
ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের বিশ্লেষক মুহাম্মদ শেহাদা বলেন, “নেতানিয়াহু শুরু থেকেই যুদ্ধবিরতি ভাঙার সুযোগ খুঁজছেন।” তার মতে, ইসরায়েল সীমিত সহিংসতা ঘটিয়ে পরিস্থিতি পরীক্ষা করছে, যেন আবার পূর্ণমাত্রায় অভিযান শুরু করা যায়।
তবে ইসরায়েলি বিশ্লেষক ওরি গোল্ডবার্গ মনে করেন, এই ঘটনা পুরো যুদ্ধবিরতি ভেঙে দেবে না, কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো চুক্তি টিকিয়ে রাখতে গভীরভাবে বিনিয়োগ করেছে।
আল জাজিরার প্রতিবেদক নিদা ইব্রাহিম কাতার থেকে জানান, যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্ট করেছে যে তারা ইসরায়েলের গাজায় পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে দেবে না। “এখন মনে হচ্ছে, ইসরায়েল নিজস্ব শর্তে যুদ্ধবিরতি ধরে রেখে নির্বাচিত হামলার সুযোগ খুঁজছে,” তিনি বলেন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে গাজায় যুদ্ধবিরতি অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
মন্তব্য করুন


