আফগানিস্তান-পাকিস্তান আলোচনায় অচলাবস্থা, বাড়ছে সংঘাতের আশঙ্কা
ইস্তাম্বুলে তিন দিনব্যাপী আলোচনার পরও আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনা নিরসনের উদ্যোগ ব্যর্থতার মুখে পড়েছে। কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় অনুষ্ঠিত এই বৈঠকের লক্ষ্য ছিল দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সংঘাত প্রশমিত করা।
এর আগে ১৯ অক্টোবর দোহায় প্রথম দফার আলোচনায় এক সপ্তাহের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর সাময়িক যুদ্ধবিরতি হয়। তবে বিশ্লেষকদের মতে, সেই সমঝোতার ওপর ভিত্তি করে স্থায়ী শান্তি গড়ার পথে নতুন জটিলতা তৈরি হয়েছে।
পাকিস্তানি কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন, আফগান প্রতিনিধিদল ইসলামাবাদের মূল দাবি আফগান সরকারকে পাকিস্তান তালেবান (টিটিপি)-এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জায়গা থেকে সরে এসেছে।
একজন পাকিস্তানি কর্মকর্তা আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, “কাবুল থেকে নির্দেশনা পেয়ে আফগান দল আলোচনায় জটিলতা তৈরি করছে।”
অন্যদিকে আফগান পক্ষ পাকিস্তানকে দোষারোপ করেছে “সমন্বয়ের অভাব” ও “অস্পষ্ট যুক্তি উপস্থাপন” করার জন্য। আফগান গণমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, পাকিস্তানি প্রতিনিধিরা বারবার আলোচনার টেবিল ছেড়ে যাচ্ছিলেন।
আফগানিস্তানের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক উপমন্ত্রী হাজি নাজিব, আর পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের প্রতিনিধিদের নাম প্রকাশ করেনি।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে সীমান্তে দুই দেশের সেনাবাহিনীর সংঘর্ষে সৈন্য ও বেসামরিক নাগরিকসহ বহু মানুষ নিহত হয়েছেন। সংঘাত মীমাংসায় কৃতিত্ব দাবি করা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন তিনি “খুব দ্রুত আফগানিস্তান-পাকিস্তান সংকট সমাধান করবেন।”তবে পর্যবেক্ষকদের মতে, দুই দেশের মধ্যে “গভীর পারস্পরিক অবিশ্বাস ও পরস্পরবিরোধী অগ্রাধিকার” যেকোনো স্থায়ী সমাধানকে কঠিন করে তুলেছে।
উইলসন সেন্টারের সাবেক ফেলো ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক বাকির সাজ্জাদ সাঈদ বলেন, “আফগান তালেবানের টিটিপির ওপর নির্ভরতা এবং তাদের আদর্শিক ঘনিষ্ঠতা কাবুলের জন্য এই সংগঠন থেকে দূরে থাকা প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে।”
ইতিহাসে পাকিস্তানকে আফগান তালেবানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে দেখা হতো। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের পর তালেবানের ক্ষমতায় ফেরা ইসলামাবাদে অনেকেই স্বাগত জানিয়েছিলেন। কিন্তু টিটিপি ইস্যুতে সম্পর্ক দ্রুত অবনতির দিকে যায়। ২০০৭ সালে টিটিপি পাকিস্তানে দীর্ঘদিন ধরে হামলা চালিয়ে আসছে এবং দেশের সাবেক উপজাতীয় অঞ্চলগুলোর প্রশাসনিক একীভূতকরণের বিরোধিতা করছে।
ইসলামাবাদ অভিযোগ করছে, কাবুল শুধু টিটিপিকেই নয়, বরং বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি ও আইএসআইএল (আইএসআইএস) খোরাসান শাখা (আইএসকেপি)–কেও আশ্রয় দিচ্ছে। তবে আফগান সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
আফগান প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোল্লা ইয়াকুব, যিনি সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ–এর সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করেন, বলেন, “সন্ত্রাসবাদের কোনো সার্বজনীন সংজ্ঞা নেই; অনেক রাষ্ট্রই রাজনৈতিক স্বার্থে প্রতিপক্ষকে সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দেয়।” সাম্প্রতিক হামলায় কয়েক ডজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছেন।
২০২৪ সাল ছিল গত এক দশকের মধ্যে পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে রক্তাক্ত বছর—২,৫০০ জনেরও বেশি নিহত হন, আর ২০২৫ সালে তা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
টিটিপির হামলা ও সংঘর্ষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০০টিরও বেশি, জানায় আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা (ACLED)।
বিশ্লেষক ইহসানুল্লাহ টিপু মেহসুদ মনে করেন, “তালেবান ও টিটিপির সম্পর্ক আদর্শিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠা, তাই আফগান সরকার সহজে টিটিপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারবে না।”
 
আর সাংবাদিক সামি ইউসুফজাই বলেন, “দুই দেশের মধ্যে বোঝাপড়ার সম্ভাবনা এখন প্রায় নেই বললেই চলে।”
চীন, কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চললেও, বিশ্লেষকরা মনে করছেন ইসলামাবাদ হয়তো শিগগিরই সামরিক পদক্ষেপের পথে যেতে পারে।
বাকির সাজ্জাদ সাঈদ বলেন, “পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ‘ওপেন ওয়ার’-এর হুমকি ইঙ্গিত দিচ্ছে সীমান্ত পার হয়ে লক্ষ্যভিত্তিক অভিযান চালানো হতে পারে।”
তবে কাতার ও তুরস্কের পক্ষ থেকে শেষ মুহূর্তের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
সাঈদ আরও বলেন, অর্থনৈতিক প্রণোদনা ও সহায়তা প্যাকেজের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি বজায় রাখার চেষ্টা হতে পারে—যেমনটি যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে শান্তিচুক্তি করাতে ব্যবহার করেছিল।
যদিও পাকিস্তানের সামরিক সক্ষমতা অনেক বেশি, বিশ্লেষকদের মতে তালেবানদেরও রয়েছে ভৌগোলিক ও জনসমর্থনের সুবিধা। সামি ইউসুফজাই বলেন, “এই সংকট আফগান তালেবানের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিয়েছে। পাকিস্তান যদি হামলা চালায়, তাতে বেসামরিক হতাহত বেড়ে জনরোষ আরও তীব্র হতে পারে।”
তিনি সতর্ক করেন, “যদি তালেবান নেতা হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জিহাদের ফতোয়া দেন, অনেক তরুণ আফগান তালেবানের দলে যোগ দিতে পারে—যা দুই দেশের জন্যই ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনবে।”
ইউসুফজাইয়ের মতে, এই পরিস্থিতির একমাত্র লাভবান হবে টিটিপি, যারা নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে আরও হামলায় উৎসাহিত হবে।
মন্তব্য করুন





