logo
  • মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ৩০ আশ্বিন ১৪৩২

আগুনের মধ্যে মানবতার জয়—পল গ্রিনগ্রাসের নতুন ছবি ‘দ্য লস্ট বাস’

অনলাইন ডেস্ক
  ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৪৬
Apple TV+ Press

চলতি শতকের শুরুতে ‘বর্ন’ ফ্র্যাঞ্চাইজি দিয়ে হলিউডের অ্যাকশন সিনেমায় এক নতুন ভাষা এনেছিলেন পল গ্রিনগ্রাস। তাঁর ছবিতে চরিত্রগুলো থাকে অনিশ্চয়তায় ভরা, আর ক্যামেরাও যেন সেই অস্থিরতাকে প্রতিফলিত করে—নড়াচড়া করে, কাঁপে, দৌড়ায়। ছোট ছোট দৃশ্য আর লাগাতার গতির মধ্য দিয়ে পর্দায় রোমাঞ্চ তৈরিতে তিনি সিদ্ধহস্ত। পরবর্তী সময়ে নির্মিত ‘গ্রিন জোন’ ও ‘ক্যাপ্টেন ফিলিপস’–এও তিনি বজায় রেখেছেন সেই স্বকীয় ধারা। এবার তিনি ফিরেছেন দাবানলে বেঁচে থাকার এক হৃদয়স্পর্শী গল্প নিয়ে—‘দ্য লস্ট বাস’।
যদিও এই ধরনের গল্পের পরিণতি প্রায় সবারই জানা, তবু গ্রিনগ্রাসের হাতে তা পরিণত হয়েছে এক গভীর, নাড়িয়ে দেওয়া অভিজ্ঞতায়। টানটান চিত্রনাট্য, বাস্তবধর্মী অভিনয় ও শক্ত নির্মাণে ছবিটি হয়ে উঠেছে উপভোগ্য এক যাত্রা।

‘দ্য লস্ট বাস’ আগুনের মাঝেও আশার গল্প। এটি ২০১৮ সালের ক্যালিফোর্নিয়ার ভয়াবহ ‘ক্যাম্প ফায়ার’-এর সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। সেই অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৮৫ জন, আর ছাই হয়ে গিয়েছিল প্রায় দেড় লাখ একর ভূমি।
গ্রিনগ্রাস ও সহলেখক ব্র্যাড ইনগেলসবাই অনুপ্রাণিত হয়েছেন সাংবাদিক লিজি জনসন-এর ২০২১ সালের বই ‘Paradise: One Town’s Struggle to Survive an American Wildfire’ থেকে। বইটি ক্যালিফোর্নিয়ার প্যারাডাইস শহরের এক ভয়ঙ্কর বাস্তব ঘটনার কথা বলে—যেখানে স্কুলবাস চালক কেভিন নিজের জীবন বাজি রেখে একদল শিশু ও তাদের শিক্ষিকাকে বাঁচান।

ছবিতে কেভিনের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ম্যাথু ম্যাকনাহে—একজন সাধারণ, ক্লান্ত, কিন্তু সাহসী মানুষ, যিনি সংকটে হয়ে ওঠেন নায়ক। শিক্ষিকা মেরি লুডউইগ চরিত্রে আমেরিকা ফেরেরা—কঠোর অথচ মমতাময়ী নারী। সময়ের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক রূপ নেয় গভীর এক আবেগে; অনেকটা ‘দ্য আফ্রিকান কুইন’-এর ক্যাথারিন হেপবার্ন ও হামফ্রে বোগার্টের মতো।
আগুনের আগে কেভিন ছিলেন জীবনের ভারে ন্যুব্জ মানুষ—ছেলের সঙ্গে দূরত্ব, প্রাক্তন স্ত্রীর সঙ্গে তিক্ততা, অসুস্থ মা, আর পাহাড়সম ঋণ। কিন্তু বিপর্যয়ের মাঝেই শুরু হয় তাঁর মুক্তির যাত্রা। ছবিতে কেভিনের ছেলের চরিত্রে বাস্তব জীবনেও তাঁর ছেলে লেভি ম্যাকনাহে—যা গল্পে বাস্তব আবেগকে আরও গভীর করে।

গ্রিনগ্রাসের ক্যামেরা যেন নিজেই আগুনের শিখা—এক স্থান থেকে আরেক স্থানে দৌড়ায়, পর্দা জ্বালিয়ে তোলে। বিদ্যুৎবাহী একটি ত্রুটিপূর্ণ তার থেকে শুরু হয় ভয়াবহ আগুন, আর স্কুলের শিশুদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব নেন কেভিন। নিজের অসুস্থ সন্তানের খোঁজে যাওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি থেমে যান না।
বাস যখন ধোঁয়ায় ভরে উঠছে, শিশুরা জ্ঞান হারাচ্ছে, তখন মেরি বলে ওঠেন, “হয়তো ঘুমিয়ে পড়াই ভালো।” কেভিন দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দেন, “এভাবে কথা বলো না।”

ফায়ার ডিপার্টমেন্টের সদর দপ্তরে তখন বিশৃঙ্খলা—কেউ কারও কথা শুনছে না, পরিস্থিতি হাতের বাইরে। গ্রিনগ্রাসের ক্যামেরা সেই ভয়াবহ বাস্তবতাকে এমনভাবে ধরে যে খবরের ফুটেজও ম্লান লাগে। ‘দ্য লস্ট বাস’ যেন আমাদেরও নিয়ে যায় সেই আগুনের নরকে, যেখানে প্রতিটি নিঃশ্বাসে মৃত্যু ঘনিয়ে আসে। আগুন, ধোঁয়া, বাতাসের ঘূর্ণি, আর সারি সারি পোড়া গাড়ি—সব মিলিয়ে নরকের প্রতিচ্ছবি।

চিত্রগ্রাহক পল উলভিক রকসেথ-এর সঙ্গে এটি গ্রিনগ্রাসের দ্বিতীয় কাজ। তাঁদের ক্যামেরার কাঁপুনি যেন বাস্তবের তীব্রতা তৈরি করে। কেউ কেউ হয়তো মাথা ঘুরে যাবে, কিন্তু এই অস্থিরতাই ছবির প্রাণ।
বাস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়ায় দর্শক জানে—সবাই বেঁচে যাবে। তবু উত্তেজনা একটুও কমে না। অন্ধকার ধোঁয়া, জ্বলন্ত গাছের ডাল, আর বিপজ্জনক পাহাড়ি রাস্তা—সবই রোমাঞ্চ আর আতঙ্কে ভরা। ‘দ্য লস্ট বাস’ দেখায়, পরিচিত ঘটনার মাঝেও কীভাবে নতুন আলো ফেলা যায়।

সিনেমার চরিত্রগুলোর নামও বাস্তবের মতোই রাখা। কেভিনকে চালাতে হয় আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তায়, যেখানে ফোন ও রেডিও বন্ধ, বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। তাঁকেই মেরির সঙ্গে বাঁচাতে হয় ২২ জন শিশুকে।
নির্মাতা এখানে শিশুদের আতঙ্ক নয়, বরং কেভিন ও মেরির মানসিক লড়াইয়ের ওপর জোর দিয়েছেন। মেরি একদিকে শিশুদের সান্ত্বনা দেন, অন্যদিকে নিজের ভয় লুকিয়ে রাখেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, “ভয় হচ্ছে, হয়তো ছেলেকে আর কখনো দেখব না।”

শেষে পর্দায় ভেসে ওঠে—বৈদ্যুতিক সংস্থাকে আদালত আগুনের জন্য দায়ী করেছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প (যার নাম সরাসরি বলা হয়নি) দোষ চাপান বনবিভাগের ওপর। ফায়ার বিভাগের প্রধান সংবাদ সম্মেলনে এসে বলেন, “এমন আগুন এখন বারবার ঘটছে”—কিন্তু আবেগে থেমে যান। তিনি উচ্চারণ করতে পারেন না “জলবায়ু সংকট” শব্দটি। এখানেই ছবির সামান্য দুর্বলতা—কারণ মূল বার্তাটি পরিবেশগত দিক থেকে পূর্ণতা পায়নি।
তবু দুই ঘণ্টা নয় মিনিটের ছবিটি সংযমী, বাস্তব ও আবেগঘন। অপেক্ষমাণ মা–বাবাদের দৃশ্যেও অতিরিক্ত নাটক নেই—বরং সংযমই ছবির শক্তি।

এক পর্যায়ে ঘোষণা আসে, আর কোনো সম্পদ অবশিষ্ট নেই—এখন কেবল মানুষকে বাঁচাতে হবে। গ্রিনগ্রাস দর্শককে শেখান না; তিনি ভয়, তাপ ও আশার মধ্য দিয়ে বাস্তবের তীব্রতাই অনুভব করান—এখানেই তাঁর সাফল্য।

তথ্যচিত্র নির্মাতা হিসেবে শুরু করা গ্রিনগ্রাস সব সময়ই বাস্তব ঘটনা পর্দায় ফুটিয়ে তোলায় আগ্রহী। তাঁর ভাষায়, “আমি চেয়েছি তথ্যচিত্র ও পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমার মধ্যে সঠিক ভারসাম্য খুঁজে পেতে।”
এই দর্শন থেকেই জন্ম নেয় ‘ক্যাপ্টেন ফিলিপস’ ও ‘ইউনাইটেড ৯৩’-এর মতো চলচ্চিত্র। সংবাদমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “‘দ্য লস্ট বাস’ আমার সিনেমাটিক ধারার কাজগুলোর মধ্যে পড়ে।”

২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর, ক্যালিফোর্নিয়ার বাট কাউন্টিতে বৈদ্যুতিক ত্রুটির কারণে শুরু হয় ভয়াবহ আগুন। সেই ঘটনাই তাঁকে অনুপ্রাণিত করে। তাঁর মতে, এটি শুধু প্রক্রিয়াগত নয়, বরং গল্পের থিম—বন্য আগুন, মানবিক সাহস ও পরিবেশগত সংকটের সমন্বয়—তাঁকে টেনেছিল।

পুরো সিনেমাটি শুট করা হয় নিউ মেক্সিকোর এক পরিত্যক্ত আর্টস কলেজে, যেখানে রাস্তা ও বাঁকগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল। আগুনের দৃশ্য তৈরি হয় গ্যাস লাইনের নিয়ন্ত্রিত শিখা দিয়ে। তিনি বলেন, “আমরা শুট করেছি ম্যাজিক আওয়ারে, যাতে আগুনের প্রাকৃতিক আলো ধরা যায়।”

শিশুদের নিরাপত্তার জন্য নেওয়া হয় কঠোর ব্যবস্থা—প্রতিটি স্টান্ট বারবার অনুশীলন করা হয়, মানসিক সুরক্ষার দিকেও বিশেষ নজর দেওয়া হয়।

গ্রিনগ্রাসের মতে, “আমরা চাইছিলাম আগুনটা যেন ‘Jaws’-এর হাঙরের মতোই এক চরিত্র হয়ে ওঠে।”
‘দ্য লস্ট বাস’ তাই শুধু আগুন থেকে বাঁচার গল্প নয়—এটি সাধারণ মানুষের অসাধারণ হয়ে ওঠার এক অনুপ্রেরণাদায়ক কাহিনি।

তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
12